আমরা জন্মের পর থেকেই শিখছি। কিন্তু যা পড়ি, যতটুকু পড়ি তার সবটুকুই কিন্তু আমাদের মনে থাকে না। অধিকাংশই ভুলে যাই, এর কারণ কী? আপনার মস্তিষ্ক সব সময়ই অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি ও তথ্য মুছে ফেলে ব্রেনের অতিরিক্ত চাপ কমায়। এবং এর ফলে আমরা সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে পাই। কিন্তু যখন আপনি নতুন কিছু শিখছেন তখন ব্রেনের এই ফাংশন আপনার নতুন শেখা তথ্য মুছে ফেলে ঝামেলায় ফেলে দেবে। নতুন শেখা তথ্যগুলো শর্ট টাইম মেমোরিতে জমা থাকে, ফলে এগুলো সহজেই হারিয়ে যেতে পারে। যদি আপনি নতুন শেখা জিনিসগুলো বারবার চর্চা করেন কিংবা সময় পেলেই মনে করার চেষ্টা করেন তাহলে ব্রেন এটাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে লং টাইম মেমোরিতে স্থানান্তর করবে। এবং আপনি তথ্যটি সহজে ভুলে যাবেন না। তাই নতুন কিছু শিখলে নিয়মিত চর্চা করাটা জরুরি। বেশি সময় না পেলে অন্তত অল্প কিছুক্ষণ একটু চোখ বুলিয়ে নিলেও সেটা কাজে দেবে। নতুন কিছু শেখার এক ঘন্টার মধ্যেই তার অর্ধেক আপনি ভুলে যাবেন যদি চর্চা না করেন। এবং এক সপ্তাহ পর মাত্র ২০ ভাগ তথ্য আনার মনে থাকবে। তাই চর্চা করাটা অত্যন্ত জরুরি। ছোটবেলায় অভিভাবকরা যে বারবার পড়তে বলতেন সেটাও কিন্তু বৈজ্ঞানিক ।জোর করে খুব কম সময়ে কিছু মুখস্ত করতে চাইলে আপনার ব্রেনের কাছে এগুলো শুধুই অর্থহীন কিছু সিকুয়েন্স হিসেবেই থাকে। কিন্তু যদি আপনি আসলেই ভালোমত শিখতে চান তাহলে ভালো হবে একটু সময় নিয়ে পড়া। ধারাবাহিক চেষ্টার মাধ্যমে পড়াটা আয়ত্ত করা।নতুন কিছু শেখা এবং সহজে মনে রাখার জন্য রয়েছে কিছু কৌশল । চলুন জেনে নেইঃ

 

যা পড়ছেন তা ভালোমত বুঝে পড়ুনঃ

অন্ধের মত মুখস্ত করতে যাবেন না কখনই। পড়াটা ভালমত বুঝে নিয়ে তারপর মুখস্ত করার কথা ভাবুন। তা নাহলে সময়মত জানা বিষয়টি মনে করতে পারবেন না। ধরুন আপনি আইন্স্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব কিছু না বোঝেই মুখস্ত করে ফেললেন। তাহলে আপনি হয়ত তত্ত্বের বিবৃতিটি বলতে বা লিখতে পারবেন। কিন্তু যদি তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে বলা হয় তাহলেই আপনার জন্য কাজটি রীতিমত অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই প্রথমেই কিছু না বুঝেই কোনকিছুই মুখস্ত করবেন না। ভালমত বুঝে নিন তারপর মুখস্ত করুন। আর বিষয়টি ভাল বুঝতে পারলে মনে রাখা কিংবা মুখস্ত করা এবং সময়মত আবার স্মরণ করতে সুবিধা হবে। এবং আপনার শেখাটাও পরিপূর্ণ হবে।


বিষয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো মনে রাখার চেষ্টা করবেনঃ

একটি নতুন বিষয় শিখতে গেলে প্রথমেই এর মূল অংশটি চিহ্নিত করুন। এবং এখানেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ুন। এবং আপনার হয়তো যতটুকু পড়লেন তার পুরো অংশটা নাও লাগতে পারে। কিংবা পরীক্ষার হলে পুরো বিষয়ে বিস্তারিত লেখার সময় হবে না। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সবচেয়ে আগে এবং গুরুত্ব দিয়ে শেখার চেষ্টা করুন। তাহলে পুরো পড়াটা মনে রাখা অনেক সহজ হবে। বিষয়ের মূল কথাগুলো যদি ভাল জানেন তাহলে সবটুকু মুখস্ত করার দরকার পড়বে না। মূল বিষয়টা কিংবা এর সারসংক্ষেপ যদি জানেন তাহলে পুরো বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে পারবেন সহজেই। আর অতিরিক্ত শব্দের বোঝা থেকেও মুক্তি পাবেন। ধরুন আপনি ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস পড়ছেন , তাহলে আপনার সহজে মনে রাখার জন্য বিস্তারিত মুখস্ত না করে মূল বিষয়গুলো মুখস্ত করুন। যেমন এক্ষেত্রে বিপ্লব কবে, কোথায়, কেন হয়েছিল, এর মূল বিরোধের জায়গায় কারা ছিল, নেতৃত্বে কে বা কারা ছিল। এই বিপ্লবের ফলটি কেমন হয়েছিল শুধু সেই বিষয়গুলো জেনে নিন তাহলে আপনি ফরাসী বিপ্লব সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তাই প্রথমেই সারসংক্ষেপটি জেনে নিন।

নিয়মিতভাবে পাঠ্য বিষয় পরিবর্তন করুনঃ

একই ধরনের একাধিক বিষয় যখন একটানা পড়বেন তখন মস্তিষ্ক বিষয়গুলো সহজে আলাদা করতে পারবে না। ফলে পরীক্ষার হলে কিংবা অন্য প্রয়োজনের সময় আপনার জানা একই ধরনের বিষয়গুলো জট পাকিয়ে যাবে। সহজে আলাদা করতে পারবেন না। এই সমস্যা এড়ানোর জন্য একই ধরনের বিষয়গুলো যখন পড়বেন তখন এগুলোর মাঝে খানিকটা বিরতি দিয়ে ভিন্ন ধরনের অন্য একটা বিষয় পড়ে নিন। তাহলে জানা জিনিসগুলো জট পাকিয়ে যাবে না। ধরুন বাংলার ইতিহাস পড়ছেন। এবং পাল, সেন, মোঘল ইত্যাদি বিভিন্ন শাসনামল আপনার জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এক একটি শাসনামল নিয়ে পড়ার পর অন্য কোন বিষয় পড়ে নিন। তাহলে আর সমস্যা হবে না। এই চর্চাটির ফল আপনারা পরীক্ষার হলে গেলেই বুঝতে পারবেন।

বিপরীত শব্দ বা বিষয় দিয়ে শেখার চেষ্টা করুনঃ

ভাষা শেখার জন্য সবচেয়ে উপযোগী প্রক্রিয়া হল বিপরীত জিনিস দিয়ে শেখা। যদি তৃতীয় কোন ভাষা শিখতে যান তাহলে খেয়াল করবেন একটা শব্দ শেখালে তার বিপরীত শব্দটিও সাথে শেখানো হয়। কারণ তাহলে একসাথে দুইটা শব্দ শেখা হয়ে যায় এবং জিনিসগুলো সহজেই মনে থাকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এজন্যই পার্থক্য শেখান হয় এবং পরীক্ষায় লিখতে দেয়া হয়। ছোটবেলা থেকেই আমরা জড়-জীব, ধাতু-অধাতু, উদ্ভিদ-প্রাণী, ত্বরণ-মন্দন এমন অসংখ্য পার্থক্য পড়ে আসতে হয়। দুইটি বিষয়ের পার্থক্য জানলে আপনি আলাদাভাবে প্রত্যেকটা বিষয় সম্পর্কেই জানবেন। আলাদাভাবে মুখস্ত করার প্রয়োজন পড়বে না।


নতুন শেখা বিষয়টিকে পূর্বের জানা কোন বিষয়ের সাথে তুলনা করুনঃ

এটি সহজে শেখার একটি ভাল টেকনিক। নতুন যে জিনিসটি শিখলেন এটিকে পূর্বের জানা কোন বিষয়ের সাথে তুলনা করুন। যেমন আপনি যদি সমান্তর ধারা জানেন এবং গুণোত্তর ধারা শিখতে যান তাহলে সমান্তর ধারার সাথে তুলনা করুন, দুইটার মিল-অমিলগুলো বের করুন তাহলে সমান্তর-গুণোত্তর দুটি ধারাই অতি সহজে, একই সাথে মনে থাকবে। এভাবে প্রত্যেকটি নতুন জিনিসকে শেখার চেষ্টা করে দেখুন, অনেক সহজে শিখতে পারবেন।

 

নতুন বিষয় দিয়ে গল্প বানানঃ

শেখা বিষয়গুলো যদি কোন ধারাক্রমে মনে রাখার প্রয়োজন হয় অথবা সহজে মনে রাখতে পারছেন না বারবার ভুলে যাচ্ছেন তাহলে এটি নিয়ে মনে মনে গল্প বানান। গল্পের আকারে শেখা জিনিসগুলো অনেকদিন মনে থাকে। কারণ এটি আপনার লং টাইম মেমোরিতে জমা হবে। খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন ছোটবেলায় গল্পে গল্পে যেসব জিনিস, নীতিকথা, ভালমন্দ কিংবা যেকোন বিষয় শেখানো হয়েছে সেসব অনেকদিন মনে থাকে। এগুলো মানুষ সহজে ভুলে না।

 

পড়াটি রেকর্ড করে রাখতে পারেন পরে চর্চা করার জন্যঃ
এখন সেলফোনের মাধ্যমে তো রেকর্ড করা আরও সহজ । হুমায়ূন আহমেদের আজ রবিবার নাটকটি নিশ্চয়ই অনেকেই দেখেছেন? এই নাটকে জাহিদ হাসান ছিলেন একজন সাধাসিধা গণিতের ছাত্রের ভুমিকায়। একটি টেপরেকর্ডারে পড়া রেকর্ড করে তাকে খুব হাস্যকরভাবে পড়া শুনতে দেখি। অবশ্য গণিতের ক্ষেত্রে এভাবে পড়াটা হয়তো হাস্যকর দেখাচ্ছে। কিন্তু অন্য কোন বর্ণনামূলক বিষয়ে পড়াশোনার জন্যই এই রেকর্ডারের কৌশলটি অনেক কাজে দেয়। শেখার একটি মাধ্যম হচ্ছে শোনা, তাই পড়া ও লেখার পাশাপাশি শোনাটাও অনেক বেশি কাজে দেয়। যেসব জিনিস শিখতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ছেন, মনে থাকছে না সেসব বিষয়গুলো রেকর্ড করে শোনে শোনে সহজেই শিখে ফেলতে পারবেন।

 

মনের মধ্যে বিষয়টি কল্পনা করুনঃ

যে বিষয়টি পড়ছেন বা ক্লাসে লেকচার শুনছেন সেটি মনে মনে কল্পনা করুন। মনের পর্দায় যদি এর একটি ইমেজ তৈরি করে নিতে পারেন তাহলে লং টাইম মেমোরিতে সংরক্ষণ হবে। এবং অনেকদিন মনে থাকবে। ধরুন আপনি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র পড়ছেন। পড়ার সময় যদি মহাকর্ষীয় আকর্ষণের বিষয়টি কল্পনা করে নিতে পারেন তাহলে শেখাটা আপনার জন্য অনেক সহজ হবে। বিজ্ঞানের অনেক কিছুই শুধু ধরে নিয়ে বা কল্পনায় একটা ফ্রেম কল্পনা করে করতে হয়। এবং আপনি যদি থিওরি অব রিলেটিভিটির টুইন প্যারাডক্স, টাইম ডাইলেশন এমন বিষয়গুলো মনে মনে কল্পনা করে না নেন তাহলে বুঝতেই পারবেন না। এমনিভাবে জ্ঞানের যে কোন শাখার জন্যই এই কথাটি প্রযোজ্য হবে। কবিতা, গান এগুলো এতো সহজেই মুখস্ত কেন হয়ে যায় জানেন? হ্যাঁ, এগুলো পড়ার সাথে সাথে চোখের সামনে দৃশ্য ভেসে উঠে বলেই এতো সহজে শেখা হয়ে যায়। অবশ্য এর সাথে গান, কবিতার ছন্দ ও সুরের ব্যপারটাও আছে। সুতরাং কল্পনা করুন পড়ার সময়। কল্পনা করা আপনাকে পড়া মনে রাখতে এবং প্রয়োজনে আবার স্মরণ করে ব্যবহার করতে সাহায্য করবে।

 

সেরা শিক্ষা উপকরণটি ব্যবহার করুনঃ

কখনই নিম্নমানের শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করবেন না । নিতান্ত বাধ্য না হলে করবেন না। চেষ্টা করবেন সব সময় সেরা কিংবা বইয়ের লেটেস্ট এডিশনটাই নিতে। তথ্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই ক্রমবর্ধমান তথ্যের যুগে পুরনো সংস্করণের বই পড়া আপনাকে স্বভাবতই পিছিয়ে দেবে। পুরনো জিনিসগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়গুলো আপনার নষ্টই হবে এক অর্থে। কেননা এখনকার প্রশ্নকর্তা, পরীক্ষকরা নতুন তথ্যই চাইবেন আপনার কাছে। তাই নতুন শিক্ষা উপকরণ এবং বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণটাই পড়ুন।

 

পড়ার সাথে সাথেই বেশি বেশি লিখুনঃ

পড়ার সাথে সাথেই লিখলে পড়া অনেক দ্রুত শেখা হয় এবং অনেকদিন মনে থাকে। তাই পড়ার সাথে সাথেই লেখার চেষ্টা করুন। যত বেশি লিখবেন পড়া তত বেশিদিন মনে থাকবে। পরার সাথে যদি কোন চিত্র থাকে তাহলে সেটিও খুব ভালভাবে কয়েকবার আঁকুন দেখবেন শেখা হয়ে গেছে।

 

পড়াশোনার স্থান নির্দিষ্ট করে নিনঃ

পড়ার জন্য নিজের পছন্দমত একটি শান্ত, নিরিবিলি জায়গা বেছে নিন। এবং প্রতিদিন একই জায়গায় বসে পড়ার চেষ্টা করুন। তাহলে নির্দিষ্ট স্থানের সাথে একটি পড়াশোনার মনোভাব তৈরি হবে। এবং যদি অন্য কথাও বসে পড়েন তাহলে আপনার প্রিয় সেই জায়গাটির কথা মনে মনে কল্পনা করে নিন। ফলে আপনার মনযোগ আসবে পড়ায় এবং পঠিত বিষয়টি সহজে শেখা সম্ভব হবে। কেননা পড়ার সময় চারপাশের পরিবেশও আমাদের পড়াশোনাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে।

 

তথ্যসূত্রঃ  ইন্টারনেট

 


Comments