আমার পথ

-কাজী নজরুল ইসলাম

“বল বীর

বল উন্নত মম শির।

শির নেহারি আমরি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।

বল বীর-

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি

চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি

ভুলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর।”

ক) ‘আমার পথ’ প্রবন্ধটি কোন গ্রন্থের অন্তর্গত।

খ) ‘মানুষ ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম’- ব্যাখ্যা কর।

গ) “আমার পথ দেখাবে আমার সত্য”- এই বিষয়টি ‘আমার পথ’ ও উদ্দীপকে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

ঘ) ‘আত্মাকে চিনলেই আত্মনির্ভরতা আসে বিষয়টি উদ্দীপক এবং প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা কর।

(ক) ‘আমার পথ’ প্রবন্ধটি কাজী নজরুল ইসলামের সুবিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রুদ্র-মঙ্গল’ থেকে সংকলিত হয়েছে।

(খ) ‘আমার পথ’ নামক প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম সত্য বিশ্বাসে বিকশিত প্রাণ প্রাচুর্যে পূর্ণ এক আমি সত্তাকে প্রকাশ করেছেন। যার মূলে আছে মানুষের মুক্তি তথা সব মানুষের কল্যাণ আর শুভ পরিণাম।

পৃথিবীতে নানা মত আর পথ আছে, আছে নানা বিশ্বাস আর ধর্মবোধ। তবে এগুলোর মধ্যে মানব ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। মানুষ যখন এই মানব ধর্মকে সবার ওপরে স্থান দেবে, সব ভুল থেকে বেরিয়ে আসবে, চিন্তা হবে কল্যাণকামী আর মানবপ্রেমী তবেই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রাণের সম্মিলন ঘটানো সম্ভব হবে। মানুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হতে পারলেই ধর্মের সত্য উন্মোচিত হবে, এক ধর্মের সঙ্গে অপর ধর্মের বিরোধ মিটে যাবে। গোটা মানুষ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা তখনই সম্ভব হবে যখন ঐক্যের মূল হবে এ মানুষ ধর্ম। কাজী নজরুল ইসলাম এই দিকটিই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

(গ) ‘আমার পথ’ নামক প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক আপন নেতৃত্বের গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি উদ্দীপকেও আমরা লক্ষ্য করি এক তেজদীপ্ত আমি সত্তাকে। যে সত্তা মিথ্যা, শোষণ আর শাসকের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে পথের কাঁটা চরণ তলে একলা চলার তাগিদ দিয়েছেন।

উদ্দীপকে আমরা লক্ষ্য করি এক দুর্দমনীয়, দুর্বার, দুর্বিনীত আমি সত্তাকে। যে সত্তা অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করে না, অশুভ মহাক্ষমতা দেখে পিছু হটে না, যে সত্তা মানবমুক্তির জন্য সামনে এগিয়ে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে রাঙা সকাল নিয়ে আসে। ভীরু, কাপুরুষদের মানা তাকে বারণ করতে পারে না এই পথ থেকে ফিরে আসতে, যদি তার সঙ্গী-সাথী কেউ নাও জোটে তবুও সে তার লক্ষ্যে অবিচল, নেতৃত্বের নিশান উড়িয়ে নতুন পথের সন্ধান দিতে সদা তৎপর।

অপরদিকে আমাদের পঠিত ‘আমার পথ’ নামক প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বলেছেন, নিজেকে চিনলেই আত্মনির্ভরতা আসে, যে সত্য ও মিথ্যা উভয়কে চিনে সে কখনও মিথ্যাকে ভয় পায় না, মানুষ যখন সত্য পথের পথপ্রদর্শক কাণ্ডারি হতে পারে, নিজেকে চিনতে পারে তখন মানুষের মনে আপনা আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে, সে আপন সত্য ছাড়া কাউকে কুর্নিশ করে না। তার এই দুর্বিনীত সত্তাকে কেউ যদি দম্ভভাবে তাতে কোনো ক্ষতি নেই, কেন না প্রাবন্ধিক আমাদের শিখিয়েছেন যে, বিনয় নিজের সত্যকে অস্বীকার বা মুছে ফেলে ওরকম বিনয়ের চেয়ে অহংকারের পৌরুষ অনেক অনেক ভালো।

(ঘ) ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম এমন এক ‘আমিত্ব’ শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন, যে সত্তা কিনা সত্য প্রকাশে নির্ভীক ও অসংকোচ। উদ্দীপকেও আমরা এই আমি সত্তার সত্য প্রকাশে দৃঢ়তা প্রত্যক্ষ করি।

আমাদের পঠিত ‘আমার পথ’ নামক প্রবন্ধে আমরা এক আমি সত্তাকে দেখি। প্রাবন্ধিক বলতে চেয়েছেন যে, আমি সত্তা সত্য কল্যাণকর তা রুদ্র তেজে মিথ্যার ভয়কে জয় করে সত্যের আলোয় নিজেকে চিনে নিতে সাহায্য করে। তার এ পথ নির্দেশকে সত্য অবিনয়কে মেনে নিতে পারে কিন্তু অন্যায়কে সহ্য করে না। প্রাবন্ধিক তার ঔপনিবেশিক সমাজের শৃংখল অবলোকন করে বলেছেন, সুস্পষ্টভাবে নিজের বিশ্বাস আর সত্যকে প্রকাশ করার সাহস না থাকলে ব্যক্তি জীবনে নেমে আসে পরনির্ভরতা আর ভূলুণ্ঠিত হয় তার বক্তিত্ব। সত্যের দাপটে দাম্ভিক হওয়া প্রাবন্ধিকের কাছে গ্রহণযোগ্য; কেন না এ সত্য দম্ভ যাদের আছে তাদের পক্ষেই কেবল অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।

উদ্দীপকে আমরা দেখতে পাই এক দুর্বিনীত আমি সত্তা যে সত্য প্রকাশের দাম্ভিক হতে পিছপা হয় না। এই আমি সত্তাকে আমরা লক্ষ্য করি ঔপনিবেশিক শোষণ বঞ্চনা আর পীড়াদায়ক শাসকগোষ্ঠীর সামনে চির দুর্দমনীয়। উদ্দীপদের কবি প্রতিটি মানুষকে পূর্ণ এক আমি’র সীমায় ব্যাপ্ত করতে চেয়েছেন। তাই ‘আমি’র অসীম তেজ যখন ‘আমরা’ হয়ে উঠবে তখন তাকে আর দমানো সম্ভব নয়। তবে সব প্রাণ জাগানোর আগে নিজের প্রাণ জাগানোর দিকটাই উদ্দীপকে মুখ্য হয়ে ফুটে উঠেছে।

উদ্দীপক ও আমাদের পঠিত ‘আমার পথ’ নামক প্রবন্ধে সত্য উপলব্ধি করে অমিত তেজদীপ্ত এক আমি সত্তাকে পাই। মানুষ যখন তার আহংবোধ দিয়ে নিজেকে চিনে তখন বলতে পারে ‘আমার কর্ণধার আমি, আমার পথ দেখাবে আমার সত্য।’ উদ্দীপক ও আমাদের পঠিত ‘আমার পথ’ নামক প্রবন্ধে এই চির কল্যাণকর সত্যকেই আমরা প্রত্যক্ষ করি।

 


Comments