আসসালামু আলাইকুম বলার পর ভরাট কণ্ঠে উত্তর এলো, ওয়ালাইকুম আসসালাম। জানতে চাওয়া হলো তার নাম। উত্তরে সে জানাল, 'আমার নাম বন্ধু।' কেমন আছ জানতে চাইলে বললো, 'ভালো। তুমি?'

আমি ভালো আছি।

তুমি কোন দেশে জন্ম নিয়েছ?

বাংলাদেশে। এখানে সাতশ'র ওপর নদী আছে।

তুমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানো?

'তখন তো আমি জন্মই নিইনি। তবে আমি জানি, ১৯৭১

সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।'

যার সঙ্গে কথা হচ্ছে সে একটা রোবট। আবেদনময়ী চেহারা নেই। মাথাটা দেখতে ছয় ইঞ্চি আকারের স্মার্টফোনের মতো। সাবলীল গড়নের রোবোকপের মতো শরীর দুলিয়ে না হলেও হাত নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানায়। দৃঢ় পায়ে চলাচল করতে পারে।

বাংলা ও ইংরেজিতে আলাপ করা ছাড়াও শিক্ষকের মতো যেমন ক্লাস নিতে পারে, তেমনি রেস্তোরাঁয় খাবারও পরিবেশন করতে সক্ষম।

কথা হচ্ছিল, বন্ধু নামের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সোশ্যাল রোবটের সঙ্গে। রোবটটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশের তরুণ নাজমুস সাকিব। ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে 'এ' লেভেল পরীক্ষার্থী সাকিবের সঙ্গে বন্ধুকে শৈশব থেকে কৈশোরে নিয়ে যেতে তাকে সাহায্য করছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল নাইম অর্ণব।

সে এই হিউম্যানয়েড সোশ্যাল রোবটটির ইউজার ইন্টারফেস (ইউআই) উন্নয়নে কাজ করছে। পাশাপাশি রোবটটির ভাষা-দক্ষতা এবং জ্ঞানের ভাণ্ডার ঋদ্ধ করতে ডাটাবেজ উন্নয়নে কাজ করছে

ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শরিফুর রহমান। কথা প্রসঙ্গে বন্ধুর উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সাকিব জানান, বন্ধু এখন বাংলা ভাষার মৌলিক শব্দ ও সরল বাক্য জানে। ইংরেজিতে দখল থাকায় আপাতত দেশের প্রথম এই দোভাষী রোবটটি কথা বলার সময় অনুবাদ করে বলে।

অজানা বিষয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে, গুগল করে উত্তর দেয়। আর যে বিষয়ে জানে না, সে বিষয়ে চুপচাপ থাকে। পরে জানতে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে। আমরা ওকে কয়েকবার বলতেই সে শিখে ফেলে। বন্ধুর বাংলা উচ্চারণ পরিশীলিত করতে এখন গলদঘর্ম প্রচেষ্টা চলছে। উন্নয়ন করা হচ্ছে বাংলা স্পিচ রিকগনিশন (উচ্চারণ অনুধাবন) সফটওয়্যার। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, এরই মধ্যে রসায়নশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছে 'বন্ধু'। শিখে ফেলেছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতি, ক্রীড়া ইত্যাদি বিষয়েও বেশ দখল আছে।

সাকিব জানালেন, দুই বছর আগে প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর এন্ট্রাপ্রেনরশিপ পুরস্কার নিতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন তিনি। অন্ধদের জন্য চশমা তৈরি করে পুরস্কার নিতে গিয়ে সেখানে তিনি দেখেন টেসলারের চালকবিহীন গাড়ি। ওই সময় থেকে শুরু হয় বন্ধু তৈরির প্রক্রিয়া। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ১৫ হাজার রিয়াল নিয়ে রোবট নির্মাণে কাজ শুরু করেন।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় প্রথম পুরস্কার এবং ঢাকা রেসিডেরসিয়াল মডেল কলেজ আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় মেকানিক্যাল বিভাগে প্রথম পুরস্কার পান। কিন্তু এরই মধ্যে টাকার অভাবে বন্ধুর নির্মাণ প্রক্রিয়া থেমে যায়।

অবশেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করে পাওয়া ৩০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু হয় স্থগিত কাজ এগিয়ে নেওয়ার পালা। এরই মধ্যে প্রায় খরচ হয়ে যায় পাঁচ লাখ টাকা।

ব্যবসায়ী বাবা আবু সাদাত মোহাম্মদ আলী ও মা শাহিদা আবেদা চৌধুরীর স্নেহের ছায়ায় অবশেষে আলোর মুখ দেখে বন্ধু। নাজমুস সাকিব বললেন, প্লাস্টিকের তৈরি বন্ধুর মাথায় ব্যবহূত হয়েছে একটি নিউরাল ইঞ্জিন (ব্রেইন)। এখানেই সে যা শেখে বা তাকে যা শেখানো হয়, তা সংরক্ষণ করে। ওর শরীরে রয়েছে দুটি আর্ম প্রসেসরভিত্তিক কম্পিউটার। আর হাত ও পায়ে রয়েছে চারটি সার্ভো মোটর। রোবটটি যেন নিজে নিজে শিখতে পারে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি।

আগামীতে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন' নিয়েও কাজ করার কথা জানালেন তিনি। এ বিষয়ে ইনোভেশন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা আরিফুল হাসান অপু বললেন, বন্ধুকে আরও সমৃদ্ধ করতে আমরা চেষ্টা করছি। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক রোবটটি দেখে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আশা করছি, বন্ধুর উন্নয়নে আইসিটি বিভাগের সহযোগিতা পাবেন সাকিব। সমকাল

 


Comments