টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি—কোনো ফরম্যাটেই সবশেষ সিরিজে ছিলেন না তিনি। এই সময়টায় মাঠে নিজেকে প্রমাণেই ব্যস্ত থাকার কথা তাসকিন আহমেদের। কিন্তু তাঁকে নামতে হয়েছে প্রমাণের অন্য লড়াইয়ে—স্ত্রী নির্যাতনের ঘটনাটি নিছকই গুজব।

নিজের ফেসবুক পেজ থেকে শুরু করে বাসায় সাংবাদিক ডেকে সুখী পরিবারের ছবিও সরবরাহ করেছে মাশরাফি বিন মর্তুজার একদার ‘আন্ডারস্টাডি’ তাসকিন।

আর মাশরাফি নিজে? জনগণে তাঁর বিস্তর বিশেষণ আছে। দলে একটাই—তিনি সবার বড় ভাই। তাঁকে অনুপ্রেরণার অব্যর্থ টোটকা মনে করে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুম। স্বভাবতই সাম্প্রতিক ব্যর্থতার হতাশা থেকে দলকে টেনে তোলার উপযোগী কোনো অনুপ্রেরণাদায়ী বাণীই তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত।

সেই মাশরাফি বৃহস্পতিবার বিকেএসপিতে ৫ উইকেট নিয়ে দলকে জিতিয়ে ওঠার পর আবাহনীর ড্রেসিংরুমে ‘ভাষণ’ দিয়েছেন বটে। তবে সে ভাষণের সবটা জুড়েই সমালোচনার তীব্র ঝাঁজ। বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, এরপর মাঠের বাইরের কোনো কীর্তিকলাপ করে কেউ সহযোগিতা পাবেন না; উল্টো জেল-জরিমানার পক্ষে অবস্থান নেবেন তিনি!

অধিনায়কের এমন বিস্ফোরণের কারণও আছে। এক উঠতি মডেলের অভিযোগের ভিত্তিতে থানায় ডাক পাওয়া রুবেল হোসেনের জন্য বিস্তর দেন-দরবার করেছেন মাশরাফি। গৃহকর্মী নির্যাতনের দায়ে পালিয়ে বেড়ানো শাহাদাত হোসেনও ‘আত্মরক্ষা’র জন্য আড়াল খুঁজেছেন মাশরাফির ছায়াতলে। আরাফাত সানির বৈবাহিক জটিলতা নিরসনেও মৃদু ভূমিকা আছে ওয়ানডে অধিনায়কের।

টিমমেটদের অনেক অপ্রকাশিত ‘অফ দ্য ফিল্ড’ ঝামেলাও মিটিয়েছেন মাশরাফি। প্রতিবারই ভেবেছেন এই বুঝি শেষ। কিন্তু সেই ভাবনা মোড় ঘুরেছে অন্য কারো নতুন কেলেঙ্কারিতে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সাব্বির রহমানের শাস্তির ‘ওজন’ কমানোর অনুরোধও নাকি মাশরাফি করেছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বরাবর। শ্রীলঙ্কা সিরিজের চিত্রনাট্যটা দিক বদলালে সে অনুরোধ অনুমোদনও হয়ে যেতে পারত।

তো, দলকে এমনভাবে আগলে রাখা লোকটা হঠাৎ এতটা খেপলেন কেন? সেদিন আবাহনীর ড্রেসিংরুমে থাকা একজন গতকাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, ‘বলবে না কেন? টিমমেট হিসেবে মাশরাফি কম জনকে এমন বিপদ থেকে উদ্ধার করেনি। কিন্তু আর কত? মাঠের বাইরের এসব ঘটনার প্রভাব মাঠের পারফরম্যান্সে পড়ছে। তা ছাড়া এসব ঘটনায় আমরা একটা হাস্যকর দলেও কি পরিণত হচ্ছি না?’

হাস্যকর না, আসলে হৃদয়বিদারক! ক্রিকেটাররাও মানুষ, অপরাধের জের ধরে জেল-জরিমানা অবাস্তব কোনো ঘটনা নয়। তবে খেলোয়াড়ি জীবনে একই দেশের তিনজনের জেল খাটার ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। মডেলকন্যা কাণ্ডে চার দিন জেল খেটে বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন রুবেল হোসেন। গৃহকর্মী নির্যাতনের দায়ে মাসখানেক সপরিবারে জেলে ছিলেন শাহাদাত হোসেন।

আরাফাত সানির কারাবাস আরো দীর্ঘতর। দলের ভেতরেই ফিসফাস আছে—ওই মডেলকন্যার মতো উদ্যোগী হলে আরো কিছু ক্রিকেটারের জেল হওয়াটা অসম্ভব নয়।

কারো কারো ঘনিষ্ঠতার ছবি কিংবা ভিডিও ক্লিপ নাকি প্রত্যাখ্যাত অনেক তরুণীর সংগ্রহেই আছে। মাঝেমধ্যে সেসব ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় ওই তরফে। তবে কোনো কোনো ঘটনার ফয়সালা হয় মধ্যস্থতার মাধ্যমে। আবার ‘প্রতারিত’দের কেউ কেউ গোপনেই থেকে যান লোকলজ্জার ভয়ে।

ক্রিকেটাররা তারকা, তার ওপর তারা পুরুষ; তাই বঞ্চিতদের কারো কারো নীরব থাকাটা এ দেশের সামাজিক বাস্তবতারই অংশ!

ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত জীবন এভাবে প্রকাশ্যে চলে আসা নিয়ে অনেকে ভ্রু কুঁচকাতে পারেন। বাইরের বিষয় মাঠে টেনে আনা কেন? তারকা যখন তখন প্রেমিকার দীর্ঘ লাইন তো পড়বেই। সেখানে এক-দুজনের সঙ্গে ঢলাঢলিতে এমন কি আর আসে যায়!

তবু আসে এবং যায়ও। একজন উঠতি ক্রিকেটারকে হঠাৎ করেই উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, তাঁর প্রত্যাখ্যাত এক বান্ধবী আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছিলেন সকাল-বিকাল। একবার হাতে-কলমে একগাদা ঘুমের বড়িও নাকি খেলেছিলেন! সামাজিকতার পাশাপাশি ক্রিকেটারদের তারকাখ্যাতির চাপও আছে।

এই দুয়ের চাপে সেই যে পথ হারিয়েছিলেন, তা ফিরে পেতে এখনো লড়ে যেতে হচ্ছে ওই উঠতি ক্রিকেটারটিকে। পথ হারানো আরেক ক্রিকেটার বান্ধবী নিয়ে অভিসারে গিয়েছিলেন মালদ্বীপে। সেই ক্ষণিকের বান্ধবী এখন অন্তরঙ্গতার ছবি প্রকাশের হুমকি দিচ্ছেন। ক্রিকেটারটির মনের অবস্থা তাই বেশ নাজুক। অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা বান্ধবী যে এমন ‘ছিঁচকাঁদুনে’ হবেন, সেটি নাকি তিনি বুঝতে পারেননি।

এই বোঝাবুঝিতেই গলদ এসব তুর্কি তরুণদের। কেউ বিয়ের মিছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নিছকই মনোরঞ্জনের জন্য। গত বিপিএলে বিবাহিত এক ক্রিকেটার ধৃত হয়েছিলেন হোটেলরুমে বান্ধবী নিয়ে। একই আসরে আরেক ক্রিকেটারকে এক ফ্র্যাঞ্চাইজি পরেরবার দলেই রাখেনি তাঁর উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে।

সবশেষ, দর্শক পিটিয়ে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞায় রয়েছেন সাব্বির রহমান। যদিও এতে তাঁর বোধোহয় হয়েছে, এমন কোনো ইঙ্গিত অদ্যাবধি মেলেনি।

অবশ্য কারই বা হয়েছে? একের পর এক ক্রিকেটারের দিকে অভিযোগের তীর ছুটে আসা তো আর বন্ধ হয়নি। এমন আবহের কারণেই আবাহনীর ড্রেসিংরুমে মাশরাফির উদিগরণ খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। ‘ভুলে ভুল করে ফেলেছে’, এমন প্রশ্রয়ে আর সমর্থনের হাত অভিযুক্তের কাঁধে রাখবেন না অধিনায়ক। মাশরাফির ‘ভাষণ’কে করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করা বিসিবিও সম্ভবত খেলোয়াড়কে বাঁচাতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে গোপন অভিযানে নামবে না।

এতে করে যদি ক্রিকেটাররা ঠিকঠাক ‘খেলেন’ মাঠে এবং মাঠের বাইরেও!

 


Comments