ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) চেয়ারম্যান আরাস্তু খান পদত্যাগ করেছেন।

একই সঙ্গে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামও পদত্যাগ করেছেন। মঙ্গলবার ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় তাদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়।


নতুন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল হাসানকে।

পদত্যাগের বিষয়ে আরাস্তু খান বলেন, ‘কাজের চাপ সামলাতে না পেরে পদত্যাগ করেছি। ব্যাংকের কারণে পরিবারকে সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তনের সময় নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন আরাস্তু খান।

এরপর ব্যাংকটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা পরিবর্তন আসে। গত সপ্তাহেও ব্যাংকটির শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কী সম্পর্ক?

ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর বিরাট প্রভাব আছে বলে অভিযোগ করা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের শীর্ষ পদগুলোতে যে রদবদল ঘটানো হয়েছে, তার ফলে ইসলামী ব্যাংকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় হলো বলে মনে করা হচ্ছে।

বুধবার ব্যাংকটির বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সভায় আরাস্তু খানকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ আবদুল মান্নান পদত্যাগ করেছেন বলে জানানো হয়। তার জায়গায় নতুন ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে আবদুল হামিদ মিয়ার নাম প্রস্তাব করা হয়।

ইসলামী ব্যাংকে বরাবরই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর একটা বিরাট প্রভাব ছিল বলে মনে করা হয়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকটির দিক থেকে এসব অভিযোগ জোর গলায় অস্বীকার করা হয়েছে।

রদবদল নিয়ে প্রশ্ন

ইসলামী ব্যাংকে হঠাৎ করে যেসব রদবদল ঘটানো হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যাংকটি সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আবদুল হান্নান। তিনি বলেন, যেভাবে পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে, তার পেছনে কোন সৎ উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না।

"এসব পরিবর্তনের কোন যুক্তি আমি পাচ্ছি না। হঠাৎ করে চেয়ারম্যান পরিবর্তন হয়ে গেলেন, তিনি পদত্যাগ করলেন। ভাইস চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলেন, তিনিও পদত্যাগ করলেন। এমডিও পদত্যাগ করলেন। এবং সম্পূর্ণ নতুন এক ব্যক্তি, যিনি মাত্র কদিন আগে বোর্ডে যোগ দিয়েছেন, তিনি চেয়ারম্যান হলেন.... এগুলো কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। এর পেছনে সৎ উদ্দেশ্য আছে বলা যায় না। অবশ্যই এর পেছনে কোন না কোন রাজনীতি আছে।"

শাহ আবদুল হান্নান বলেন, এসব পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হয়তো ইসলামী ব্যাংকে কোন দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করা। তবে তিনি দলটির নাম বলতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে ইসলামী ব্যাংকে সর্বশেষ এসব পরিবর্তনের পেছনে সরকারের কোন ভূমিকা থাকার কথা । অস্বীকার করেছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান।

তিনি বলেন, "সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের বোর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে। সুতরাং এখানে কোন গোষ্ঠী বা দল বা ব্যক্তির সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে, এমন বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। আমি বিশ্বাস করি সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকভাবেই এটা করা হয়েছে।"

বাংলাদেশে সরকারী-বেসরকারী সব ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকই এখন সবচেয়ে বড় ব্যাংক। মুনাফার দিক থেকেও ব্যাংকটির অবস্থান শীর্ষে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এটিকে বাংলাদেশের সেরা ব্যাংকের পুরস্কার দেয় লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমসের ব্যাংকার ম্যাগাজিন।


সেই পুরস্কার নিতে বিদায়ী ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ আবদুল মান্নান লন্ডনে এসেছিলেন। সেসময় বিবিসির স্টুডিওতে এসে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কোন সম্পর্কের কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করেন।

জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক
ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক কী? এ প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, "শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই ইসলামী ব্যাংকের কোন ধরণের আইনি বা অন্য কোন ধরণের সম্পর্ক নেই।"

ইসলামী ব্যাংক যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেখানে বিদেশি বিনিয়োগই ছিল সবচেয়ে বেশি, মোট বিনিয়োগের ৭০ শতাংশই এসেছিল ১১টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে। সেখানে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, দুবাই ইসলামী ব্যাংক এদের বিনিয়োগ ছিল।

অন্যদিকে বাংলাদেশের যে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ, তার মধ্যে দশ শতাংশ এসেছে শেয়ার বাজারে ছাড়া আইপিও(ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) থেকে। বাকী যে বিশ শতাংশ বিনিয়োগ, তার পঁচিশ শতাংশ দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধি ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন সেখান থেকে সরকারী বিনিয়োগ তুলে নেয়ার আগে পর্যন্ত।

কিন্তু ইসলামী ব্যাংক যেভাবে পরিচালিত হতো, সেখানে জামায়াতে ইসলামীর একটা বিরাট প্রভাব ছিল, তাদের ইচ্ছেমতই সবসময় ব্যাংকটি পরিচালিত হয়েছে, এমন অভিযোগ বহুবার ব্যাংকটির বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে।


বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান সে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "ইসলামী ব্যাংকের মূলধনে যেমন কোন বিশেষ দলের বা মতের সম্পর্ক ছিল না, আমাদের বিনিয়োগ কার্যক্রম বা ডিপোজিট যারা করছেন, সেখানেও কোন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা কখনো প্রমাণিত হয়নি।"

তিনি আরও বলেন, "আমার গত ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আমরা সম্পূর্ণ পেশাদারীত্বের ভিত্তিতে এই ব্যাংকটি পরিচালনা করেছি। এবং শুধু পেশাদারীত্বের কারণেই ইসলামী ব্যাংক সারা বিশ্বে এত সুনাম অর্জন করেছে।"

ইসলামী ব্যাংক তাদের নিয়োগ, ব্যবসা, বিনিয়োগ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে কেবল একটি দলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ, সে অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, "এটি সম্পূর্ণ অসত্য।"

তবে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুল মতিন স্বীকার করছেন, ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে যে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা আছে, সেরকম একটা ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে।

ব্যাংকের সাম্প্রতিক বড় রদবদলগুলো কি তাহলে এটিকে একটি দলের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যেই করা হচ্ছে?

এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "অনেকটা তাই, সেটা বলতে পারেন। এই পরিবর্তনটা ধীরে ধীরে আমরা করার চেষ্টা করছি। এই ব্যাংকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের পদ্ধতিতে এমন কিছু ছিল, যে কারণে একটা পার্টিকুলার দলের লোক ছাড়া এখানে অন্য কারও ঢোকাটা বলতে গেলে শূন্যই ছিল। সেখানে এখন আমরা নজর দিচ্ছি।"

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুল মতিন আরও বলেন, তাদের আনা পরিবর্তনগুলোতে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাইতে ব্যাংকের গ্রাহকের স্বার্থকেই তারা প্রাধান্য দিচ্ছেন।

"ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকের সংখ্যা কিন্তু এক কোটি সতের লাখের উপরে। জামানত আছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। কর্মচারীর সংখ্যা সাড়ে তের হাজার।

এখন এই সাড়ে তের হাজার কর্মচারী যদি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের অনুসারী হয়েও থাকে, এক কোটি সতের লক্ষ গ্রাহক কিন্তু ঐ দলের পক্ষে না, ঐ মতাদর্শের পক্ষে না। এখন আমাদের দেখতে হবে, আমরা কি এক কোটি সতের লাখ গ্রাহকের স্বার্থ দেখবো, নাকি সাড়ে তের হাজার কর্মচারী, যারা হয়তো একটি পার্টিকুলার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের স্বার্থ দেখবো?"

 


Comments