দেশে ৬৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশে টাকা পাচার, সনদ বিক্রিসহ ২৬ ধরনের গুরুতর অভিযোগ পেয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

আর অভিযোগ খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সমন্বয়ে ৫ সদস্যের উচ্চপর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথমসারির বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টাকা বিদেশে পাচার করছে।

সম্প্রতি মধ্যম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানি লন্ডারিং শুরু করেছে। এ অভিযোগে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে শোকজ পর্যন্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও সনদ বিক্রি, মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাৎ, অনিয়ম করে ভিসি-প্রোভিসি-কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া, প্রেসিডেন্টের বাণী জালিয়াতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে জমি কেনা, সাধারণ তহবিল থেকে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা নেয়া, বিদেশ ভ্রমণ, কর ফাঁকি, স্থায়ী ক্যাম্পাসের জমি কেনা থেকে শুরু করে ভবন নির্মাণে ভয়াবহ আর্থিক দুর্নীতি, নামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি জালিয়াতি, ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী কোটা না মানা, বছরের পর বছর একই ব্যক্তিকে ভিসি হিসেবে রেখে দেয়া, কোর্স শেষ না করেও ক্লাসের উপস্থিতি দেয়াসহ ভালো ফল করিয়ে দেয়া, নির্ধারিত শিক্ষকের চেয়ে অনেক কম শিক্ষক দিয়ে ক্লাস পরীক্ষা নেয়া, মদের বার আছে এমন ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন, তথ্য গোপন করে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি, ভিসা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানোর অভিযোগ তুলা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মঞ্জুরি কমিশনকে বলা হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, উচ্চপর্যায়ের ৫ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। তারাই এটি নিয়ে কাজ করছে।

প্রতিবেদনে ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষরা ট্রাস্টি বোর্ডের আজ্ঞাবহ না হলেই নানা ছুতো দেখিয়ে তাদের বিদায় করে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট কার্যালয়কে ভুল বুঝানোর মতো ঘটনা ঘটে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভিসি-প্রোভিসির রাজনৈতিক মতাদর্শ দেখেই নিয়োগের ব্যবস্থা করেন বিওটির সদস্যরা।

প্রতিবেদনে ৬৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫টিতে ভিসি, ৩২টিতে প্রোভিসি এবং ২০টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে গত মাসের ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টিতে ভিসি, ৬৮টিতে প্রোভিসি এবং ৪৩টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই। দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৯৭টি। বাকিগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়নি।

প্রতিবেদনে প্রায় ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি সদস্যরা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে বলা হয়েছে। আরো ৩টিতে বিওটি সদস্যদের কেউ বিএনপি এবং কেউ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

দেশের প্রথমসারি নর্থ সাউথের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্য, বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে জমি কেনা, সাধারণ তহবিল থেকে বিওটিদের আর্থিক সুবিধা নেয়া, বিদেশ ভ্রমণ, হিযবুত তাহরিরের বই রাখাসহ নানা অভিযোগ বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার পরিবেশ নেই উল্লেখ করে বলা হয়, গ্রীন রোডে ভাড়া ভবনে ক্যাম্পাস চালায় প্রতিষ্ঠাটি। একই ভবনে মদের বারসহ আরো অসামাজিক কার্যকলাপ এখানে হয়।

এ পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হলে সামাজিকভাবে ছাত্ররা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। যেনতেন বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়েছে ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটিকে। এটাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিবিএ, এলএসবি ও মাস্টার্স কোর্সে ১১টি সেমিস্টারে মাত্র ১৭০ জন শিক্ষার্থী পড়াশুনা করে। আর শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৫ জন।

ব্রিটিনিয়া ইউনির্ভাসিটিতে ক্লাস পরীক্ষা ঠিকমতো না হলেও শিক্ষার্থীদের ভালো সিজিপিএ দেয়া হচ্ছে। আর সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটিতে ট্রাস্টি বোর্ডের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। প্রসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায় করার অভিযোগ রয়েছে।

ইউআইটিএসের বিরুদ্ধে ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায় জামায়াতের ইসলামীর মতাদর্শের কথা বলা হয়েছে। ফারইস্ট মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্ধী কোটা শিক্ষার্থী ভর্তি করায় না।

অতীশ দীপংকর ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্ধী কোটায় শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় না। নর্দান ইউনিভার্সিটিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ হয় না।

চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে বিভিন্ন অনিয়মের মধ্যে ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টর এবং ড. নীলা ইসলামকেই দায়ী করা হয়। ৭৫ জনের বিপরীতে ৪৫০ জনকে ভর্তির অভিযোগে ইউজিসি তাদের ১০ কোটি টাকা জরিমানা করে। এ ছাড়াও ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা প্রায়ই বিরাজ করে বলে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের দশা বেশি নাজুক বলা হয়েছে।

এ ছাড়াও আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটির বিরুদ্ধে নৈতিকস্খলন, মালয়েশিয়ায় টাকা পাচার, শিক্ষকদের কম বেতন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

 


Comments