যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এখন ফেসবুক। মনের কথা, অভিব্যক্তি নিমিষেই পৌঁছে যায় শত শত বন্ধুর কাছে। এ ফেসবুকই একদিকে যেমন বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট করছে, তেমনি একে ব্যবহার করে কেউ কেউ স্বার্থ হাসিল করছে। প্রতারণার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছে ফেসবুককে।

প্রায়ই শোনা যায় ফেসবুকে পরিচয় থেকে প্রেম। এক সময় বন্ধুরূপী প্রতারকের খপ্পরে পড়ে অনেককে হারাতে হয়েছে ইজ্জত।

শুধু তাই নয়, ইজ্জত খুইয়েই শেষ হয়নি, প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে অনেককে। আবার ফেসবুককে ব্যবহার করে বহু পরিবারকে করা হয়েছে ছন্নছাড়া। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে ব্যবহার করে প্রেমিকার সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকির কথা শোনা যায় হরহামেশায়।

আবার ফেক আইডি খুলে সম্মানি লোকের সম্মানহানি করা হচ্ছে অবলীলায়। ইদানীং অনলাইন কেনা-কাটার নামেও হচ্ছে প্রতারণা। প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা জানাজানিও হচ্ছে। তারপরও মানুষ প্রতারকের খপ্পড়ে পড়ছেন। আটকে যাচ্ছেন প্রতারণার জালে।

ফেসবুকের সহায়তায় গড়ে উঠেছে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গত পহেলা বৈশাখে পোশাক মেলা ডট কম থেকে জামার অর্ডার করেছিলেন গৃহিণী হ্যাপি জাহান। তিনি বলেন, অনলাইনে যে থ্রি-পিসের অর্ডার করেছিলাম আর যে পণ্য হাতে পেয়েছি তার সঙ্গে রং ছাড়া আর কোনো কিছুরই মিল নেই। অর্ডার করেছিলাম ২ হাজার ৫০০ টাকার জামা। হাতে পেয়েছি যে জামা তার মূল্য ৫ থেকে ৮০০ টাকা।

একই ধরনের অভিযোগ করেন আদিত্য সাহা। তিনি বলেন, অনলাইনে অর্ডার করেছিলাম স্পোর্টস সু। জুতার মূল্য দোকানে ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা। তাদের অনলাইনে ছাড় চলছিল। ছাড়ে তার মূল্য দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮০০ টাকা। প্রথমত যে জুতা অর্ডার করেছিলাম সে জুতা পাইনি।

দ্বিতীয়ত সু দেবার পাঁচদিনের মাথায় সোল খুলে যায়। কথা ছিল সমস্যা হলে বদলে দেবে। বদলে দেয়া তো দূরের কথা, পরে আর ঠিক মতো কথা পর্যন্ত বলেনি। তথ্যানুযায়ী মাসিক সক্রিয়তার হিসেবে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশ্বজুড়ে ১৮৬ কোটি ছাড়িয়েছে। ২০১৭ সালের ফেসবুকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখ।

এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী বলেন, আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে ১০টি। যার মধ্যে ৬টিতে আমি সক্রিয়, ২টি ছেলে ৪টি মেয়ের নামে। এসব অ্যাকাউন্ট দিয়ে বন্ধু বানিয়ে মজা করি। এমনি এক অ্যাকাউন্ট দিয়ে স্যারের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্ক চালিয়েছি চার মাস।

কারমাইকেল কলেজ রংপুরের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মারুফুল হক মাহির বলেন, ফেসবুকে পরিচয় হয় পাবনা অ্যাওয়ার্ড কলেজের এক ছাত্রীর সঙ্গে। দীর্ঘ দিন কথা হয়। জড়িয়ে যাই প্রেমের সম্পর্কে। ভিডিও কলে কথা পর্যন্ত হয়েছে আমাদের। এভাবে চলতে থাকে। মাঝে মধ্যে আমার কাছে টাকা ধার নিতো সে। টাকার পরিমাণটা ছিল অনেক কম ২ শত থেকে ৫ শত টাকা।

আবার অনেক সময় টাকা ফেরতও দিত। এভাবে বছরখানিক যাবার পর, সিদ্ধান্ত নেই আমরা বিয়ে করে ফেলবো। সে আমাকে মাস খানেক বাহিরে থাকার মতো টাকা আনতে বলে। আমি ১০ হাজার টাকা নিয়ে যাই তাদের কলেজে। কিন্তু না বিয়ে তো দূরের কথা আমাকে জিম্মি করে সব টাকা এবং নিজের পরিশ্রমে কেনা মোবাইল ফোনটাও খোয়াই। আর কোনো দিন খোলা পাইনি তার নম্বর কিংবা ফেসবুক আইডি।

আবার আইডি হ্যাক করে বিকাশে টাকা চাওয়া, তথ্য চুরি করা, অন্যের লেখা কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেবার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।

সম্প্রতি ‘সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন’র এক গবেষণায় উঠে আসে, দেশে সাইবার অপরাধের শিকার ৫১.১৩ শতাংশ নারী এবং ৪৮.৮৭ শতাংশ পুরুষ।

গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে ফেক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন ১৪.২৯ শতাংশ নারী, ১২.৭৮ শতাংশ পুরুষ। ছবি বিকৃতের শিকার হন ১২.০৩ শতাংশ নারী, ৩.৭৬ শতাংশ পুরুষ। অনলাইনে হুমকির শিকার ৯.৭৭ শতাংশ নারী এবং এত পুরুষের সংখ্যা ৩.৭৬ শতাংশ। জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৩৩ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে ২১ শতাংশের মধ্যে ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে শরণাপন্ন হয়ে সুফল পেয়েছেন।

২৩ শতাংশ ব্যক্তি আইনি ব্যবস্থা নিয়ে হয়রানির মুখে পড়েছেন। আত্মমর্যাদা ধরে রাখতে চেপে যান ১৭ শতাংশ ব্যক্তি। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী জানান ছবি বিকৃতির কথা। তার আইডি হ্যাক করে তার ছবির মুখের অবয়ব রেখে নিচে অশ্লীল অংশ জুড়ে দেয়া হয়। ক্যাপশনে তার নম্বর দিয়ে আপত্তিকর আহ্বান জানানো হয়। পরে তিনি বড় বোনের ফোন থেকে ঢুকে দেখেন এবং পরিচিতজনদের মাধ্যমে রিপোর্ট করিয়ে ব্লক করে দেন।

তিনি বলেন, এমনি অবস্থা হয়েছিল না পারতাম কাউকে বুঝাতে না পারতাম ফোন রিসিভ করতে। পরে নম্বর পরিবর্তন করে ফেলি। কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। নতুন নম্বরেও ফোন আসা শুরু হয়। পরে বুঝতে পারি এটা পরিচিত কারো কাজ। এভাবে অনেক দিন মেবাইল বিহীন থাকার পর এই সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাহায্য না নেয়ার কারণ হিসেবে বলেন, বিষয়টি থেকে আমি মুক্তি চাইছিলাম আর কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়তে চাচ্ছিলাম না।

এশিয়া প্যাসেফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিগমা রেজা জ্যোতি। তার নামে এত পরিমাণ ফেইক আইডি ছিল যে রিপোর্ট করে ব্লক করতে করতে বিরক্ত। আইডি ব্লক করা গেলেও একটা পেইজ কিছুতেই ব্লক করতে পারছেন না। তিনি বলেন, পেইজে আজেবাজে কিছু পোস্ট দেয়া হয় না। কিন্তু কখন কি পোস্ট দিয়ে ফেলে এই নিয়ে সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তায় থাকি। তিনি বলেন, ধানমন্ডি থানায় অভিযোগ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে ফিরিয়ে দেয় জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকার কারণে।

সিলেট আম্বরখানা স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র অতনু, ফেসবুকে সে তার এক শিক্ষিকার নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে শিক্ষিকার বানানো পর্ণো ছবি আপলোড করে দেয়। অশ্লীল স্ট্যাটাস দিয়ে অতনু তার শিক্ষিকার মোবাইল ফোন নম্বরও দিয়ে দেয়। সেখানে লিখা হয়, ‘প্লিজ কল মি’। এ নিয়ে তোলপাড় হয় সর্বত্র।

৩৫তম বিসিএস উত্তীর্ণ প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন সহকারী সচিবের নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে পর্নো ছবি ফেসবুক আপলোড করে মোবাইল ফোন নম্বর দেয়া হয়। নানান প্রতারণা মূলক মিথ্যা স্ট্যাটাস দেয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও এবং ছবি ছড়ানো এবং ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করায় মুন্সীগঞ্জে মেহেদি হাসান অপি (২৮) নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও আইসিটি আইনে ৫৭ ধারায় মামলা হয়। বিয়ের আগে পাঁচ বছর ওই তরুণীর সঙ্গে মেহেদির সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক থাকাকালে মেহেদি ওই তরুণীর অশ্লীল ভিডিও ও ছবি ধারণ করে রাখে।

৬ বছর আগে ওই তরুণীর সৌদি প্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। তাদের পাঁচ বছরের একটি সন্তান রয়েছে। মেয়েটির বিয়ের পর থেকে মেহেদি ওই অশ্লীল ভিডিও ও ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ওই তরুণীকে প্রায়ই ধর্ষণ করতো। কিছুদিন পর মেহেদি সেইসব ভিডিও ফেসবুকে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের রয়েছে সাইবার ক্রাইম ইউনিট। তারা অভিযোগ গ্রহণের পর সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

আবার ফেসবুকে রয়েছে ‘সাইবার ক্রাইম ডিভিশন’ ফেসবুক পেজ। এই পেজের মাধ্যমেও অভিযোগ করা যাবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ কমিশনার কিবরিয়া রহমান বলেন, অন্যায়ের শিকার হলে আমাদের কাছে আসুন। আমাদের ইউনিট তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম।

‘সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন’র গবেষণায় উঠে আসে, দেশে সংঘটিত সাইবার অপরাধের শিকার মেয়েদের ৭৩.৭১ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। ১৮ বছরের কম ১০.৫২ শতাংশ মেয়ে এবং ৩০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে ১২.৭৭ শতাংশ, ৪৫ বছরের বেশি ৩ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান বলেন, সাইবার ক্রাইম বন্ধে আমাদের সকলের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে।

 


Comments