
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ একরামুল ইসলাম
দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস (১৮৭০-১৯২৫) ছিলেন ব্রিটিশরাজ বিরোধী ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা, আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ। তিনি একজন সুলেখকও ছিলেন। শুধু তাই-ই নয় তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস (১৮৯৭-১৯৪৫) এর রাজনৈতিক গুরু । ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর- ব্রিটিশ সরকার চিত্তরঞ্জন দাসকে জেলে পাঠিয়ে দেন। ঐ সময় চিত্তরঞ্জন দাস 'বাংলার কথা' পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। জেলে থাকা অবস্থায় পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বপান তার-ই সহ-ধর্মিনী বাসন্তী দেবী (১৮৮০-১৯৭৪)। তিনি 'বাংলার কথা' পত্রিকা ছাপানোর জন্য সুকুমার রঞ্জন দাশ-কে মাধ্যম করে কাজী নজরুল ইসলামের কাছে একটি কবিতা চেয়ে পাঠান। কাজী নজরুল ইসলাম বাসন্তী দেবীর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি। লিখেন- 'কারার ঐ লৌহ কপাট' কবিতাটি। কবিতাটি সম্পর্কে মুজজফ্র আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩) তার কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথায় লিখেন-
" আমার সামনেই দাশ পরিবারের শ্রীসুকুমার রঞ্জন দাশ বাঙ্গালার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্য পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তখন জেলে।... অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখন-ই কবিতা লেখা শুরু করে দিল।সুকুমারঞ্জন ও আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষন পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শুনাতে লাগল।"
এটা সহজেই অনুমেয়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জেল আটক কবির মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে আর তাইতো স্বল্প সময়েই উগড়ে দিতে পেরেছিলেন অগ্নিঝড়া প্রতিবাদ কারার ঐ লৌহ কপাট কবিতাটি। পরবর্তীতে 'ভাঙার গান' শিরোনামে 'বাঙলার কথা' পত্রিকায় ২০ জানুয়ারী ১৯২২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এর পরে কোন একসময় এতে সুর দেন কবি নিজেই এবং কবি নজরুল ইসলাম তার জেল জীবনে (২৩.১১.১৯২২-১৫.১২.১৯২৩) বিভিন্ন কয়েদির সাথে এ গানে কণ্ঠ দেন। আর গানটি কয়েদিদের মুখে মুখে ঘুরেছে জেল থেকে জেলে। এ গান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল আর তাই তটস্থ হয়ে ১১ নভেম্বর ১৯২৪ 'ভাঙার গান' কাব্যগ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করেন। ব্রিটিশ সরকার কখনও এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেননি। ভাঙার গান এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হতে তাই সময় লেগেছিল আরো ২৫ বৎসর অর্থাৎ স্বাধীন ভারতে ১৯৪৯ সালে। অবাক ব্যাপার ছিল, ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও ভাঙার গানের জনপ্রিয়তা কিЮ টলাতে পারেনি । ভাঙার গান এর সুরে তখন তরুণেরা মাতোয়ারা ( গোলাম রব্বানী : বাজেয়াপ্ত নজরুল : ২৪ মে ২০১৯, প্রথম আলো )।
১৯২৯ সালে অ্যালবার্ট হলে নজরুলকে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসু অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করেন, নজরুলের গান গাওয়া হবে কারাগারে , যুদ্ধক্ষেত্রে। শুধু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভাঙার গান অনুপ্রেরণার যুগায়নি, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধেও মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রেরণার উৎস ছিল গানটি। কারার ঐ লৌহ কপাট শুধু গান নয় অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে এক কঠিন হুশিয়ারী। এটা মুক্তিকামী মানুষের এক পরম সম্পদ। হৃদয়ের মনি কোঠা থেকে উৎসারিত এক ভালোবাসার নাম। সেই ভালোবাসাতেই যেন চপোটাঘাত করেছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। সম্প্রতি বলিউডের পরিচালক রাজা কৃষ্ণ মেননের 'পিপ্পা' সিনেমা মুক্তি পায়। সিনেমাটি ক্যাপ্টেন বলরাম সিংহ মেহতার জীবনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আলোচিত 'গরিবপুর যুদ্ধ' নিয়ে 'পিপ্পা' সিনেমার গল্প। যশোরের কপোতাক্ষের তীরে সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরের অধিনায়কত্বে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ভারতীয় বাহিনীর ক্যাপ্টেন বি এম মেহতা উপ-অধিনায়ক ছিলেন। যুদ্ধটি হয়েছিল ১৯৭১ সালের নভেম্বর-এ। সম্ভবত এ কারণেই পরিচালক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের 'কারার ঐ লৌহ কপাট' গানটি বেছে নিয়েছিলেন এবং সুরারোপ করছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ, আর রহমান। রাজীক হাসান (ইত্তেফাক : ২৪ নভেম্বর ২০২৩) তার শিল্পীর স্বাধীনতা প্রবন্ধে উল্লেখ করেন-
"গানের দৃশ্যটা দেখে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলো, গানটার দৃশ্যে রয়েছে- ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়ে নাচগান করে রীতিমতো উৎসব করছে আর গাইছে। ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে। চলচ্চিত্রে দৃশ্যেও পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য বুঝে সেই পরিবেশ উপযোগী গানের সুর সৃষ্টি করা সুরকারের কাজ। ঐ পরিবেশে বিপ্লবী গান কি খাটে? তাই অমন আনন্দঘন পরিবেশে 'কারার ঐ লৌহ কপাট' লোকগীতির এক সুরেলা রোমান্টিক ঢঙে গাওয়া হয়েছে।"
মোট কথা 'পিপ্পা' সিনেমার কারার ঐ লৌহ কপাট গানটির সুরারোপ প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে আঘাত হেনেছে। এর কারণ, বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনা ও আবেগের সাথে জড়িয়ে আছে কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লবী গানসমূহ। তার মধ্যে কারার ঐ লৌহ কপাট অন্যতম। তাই এ আর রহমানের সুরারোপিত গানটি সারা বিশ্বের বাঙালীদের সমালোচনার তোপে পড়েছেন। এই বিতর্ককে গুরুত্ব দিয়ে 'পিপ্পা' ছবির অন্যতম প্রযোজক সিদ্ধার্থ রায় সামাজিক মাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন-
“We understand the emotional attachment that audiences may have to the original composition and while all art is inherently subjective, if our interpretation has hurt sentiments or caused unintended distress, we offer our sincere apologies”
অর্থাৎ, আমরা মূল গানটিকে ঘিরে শ্রোতাদের আবেগকে সম্মান করি। শিল্প যেহেতু ব্যক্তিগত দৃষ্টি ভঙ্গির উপর নির্ভরশীল, সেখানে আমাদের পদক্ষেপ যদি কারো আবেগে আঘাত করে থাকে তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।
সিদ্ধার্থ রায় এটাও বলেছেন- গানের কথা ব্যবহার এবং সুরের পরিবর্তন চুক্তি অনুযায়ী করা হয়েছে। কাজী অনির্বাণ ( কাজী নজরুল ইসলামের ছোট ছেলে অণিরুদ্ধের ছেলে ) ও তার মা কল্যাণী কাজী 'পিপ্পা' সিনেমার কর্তৃপক্ষের সাথে গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেন। তবে কাজী অনির্বাণ এও বলেন- মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরী হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা কিছু শোনাননি। কাজেই পুরো ব্যাপারটির মধ্যে কুয়াশা রয়েই গেছে। ড. নাশিদ কামাল ২৪ নভেম্বর ২০২৩-এ তার ডেইলী স্টার-এ লিখিত ‘‘Controversies about Nazrul’s Tunes’ এ লিখেন-
“Controversies regarding this song and its use in the recent Bollywood film Pippa have already caused a grand furore in the subcontinent. However, Nazrul sangeet artists and lovers of Nazrul (including researchers and administrative workers) know that controversies surrounding the original tunes of the rebel poet’s verses have existed for a long time.”
ড. নাশিদ কামালের প্রবন্ধ থেকে এতটুকু হৃদয়ঙ্গম বা উপলব্ধি করা যায় ১৯-২০ ব্যবধান থাকতেই পারে কিন্তু ১৯-৩৯ কি গ্রহণযোগ্য?। এটা মেনে নেওয়া যায় না। অনেকেরই জিজ্ঞাসা এ আর রহমান কারার ঐ লৌহ কপাট গানটিকে যে ভাবে সুরারোপ করেছেন -তা কি সুর হত্যা না সুর সৃষ্টির স্বাধীনতা?
লেখকঃ ট্রেজারার, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি ঢাকা ও নজরুল বিশেষজ্ঞ